জিপি নিউজঃ “আমার সাত বছর বয়সী ছেলে কালিয়াপ্পান স্কুল থেকে ফিরে খাবার চায়। তারপর সে ক্ষুধায় কাঁদতে শুরু করে,” বলছিলেন প্রেমা সেলভাম।
কিন্তু ৩১ বছর বয়সী মা, যে ভারতের তামিল নাড়ুর সালেম জেলায় বাস করে, ছেলেকে দেয়ার মতো তার কাছে কিছু ছিল না এবং সে অসহায় বোধ করছিল।
এমনকি সে দিন, ৩ জানুয়ারি শুক্রবার, সে কিছুই রান্না করেনি, কারণ তার কাছে রান্না করার মতো কিছু ছিল না।
এ ধরণেরই কয়েকটি বেদনাদায়ক ঘটনার পর, প্রেমা তার সহ্যের চরম সীমায় পৌছায়, যা তাকে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে ধাবিত করে, এরমধ্যে একটি পদক্ষেপের কারণে তার স্থানীয় সম্প্রদায় অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া দেখায়।
“হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছিল”
“আমার কাছে দেয়ার মতো কিছু ছিল না। এটা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। এটা আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি আমার বাচ্চাদের খাবার দিতে না পারি তাহলে বেঁচে থেকে কী হবে?” বিবিসিকে সে বলে।
বিক্রি করে অর্থ আয় করার মতো প্রেমার কাছে কোন সম্পদ, গয়না, মূল্যবান জিনিস কিংবা রান্নাঘরের তৈজসপত্রও ছিল না।
“আমার কাছে ১০ রূপির একটা নোটও ছিল না,” সে বলে। “আমার কাছে শুধু প্লাস্টিকের কয়েকটি বালতি ছিল।”
এরপর সে বুঝতে পারে যে তার কাছে কিছু একটা আছে যা সে বিক্রি করতে পারে।
ওজন করে চুল বিক্রি
“একটা দোকানের কথা আমার মনে ছিল যেটি চুল কিনতো। আমি সেখানে গিয়ে আমার পুরো মাথার চুল ১৫০ রুপিতে বিক্রি করে দেই,” প্রেমা বলে।
সারা বিশ্বেই মানুষের চুল কেনা-বেচা হয় এবং ভারত শীর্ষ রপ্তানিকারক।
প্রার্থনা পূরণ হওয়ার বিনিময়ে অনেক হিন্দু পূণ্যার্থী মন্দিরে তাদের চুল দান করে থাকে।
ব্যবসায়ীরা সেগুলো কিনে নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে।
স্বামীর আত্মহত্যা
চুল বিক্রি করে সে যে অর্থ পেয়েছিলেন তা দিয়ে হয়তো একটি বড় শহরে মাঝারি মানের একটি রেস্তোরায় দুপুরের খাবার কেনা সম্ভব। কিন্তু তার গ্রামে সে সেই অর্থ দিয়ে বেশ কিছু জিনিস কিনতে পেরেছিলো।
“আমার তিন সন্তানের জন্য ২০ রুপি করে আমি তিন প্যাকেট ভাত কিনি,” সে বলে।
সে তার সন্তানদের সাথে ভাগাভাগি করে সেই খাবার খেয়েছিলো কিন্তু এটা ছিল ক্ষণিকের আনন্দ মাত্র।
প্রেমা জানতো যে সে তার শেষ উপায় ব্যবহার করে ফেলেছে এবং পরের বেলা সে কিভাবে তার পরিবারকে খেতে দেবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
বছরের পর বছর ধরে সে তার স্বামীর সাথে একটি ইটের ভাঁটায় কাজ করতো এবং বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আয় করতো তারা।
তার স্বামী নিজের ইটের ভাটা শুরু করার জন্য ঋণ নেয়, কিন্তু সেই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি এবং এর পরিবর্তে হতাশা ভর করেছিল।
সে কখনোই পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেনি এবং সে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল।
নিজের গায়ে আগুন দিয়ে সাত মাস আগে সে আত্মহত্যা করে।
চুল বিক্রির পর এবং আর কোন উপায় না থাকায়, প্রেমাও তার স্বামীর মতো একই পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিল।
প্রেমার আত্মহত্যার চেষ্টা
“আমি একটি দোকানে কীটনাশক কিনতে যাই।”
কিন্তু তার করুন অবস্থা দেখে দোকানদার তাকে তাড়িয়ে দেয়।
সে বাড়ি ফিরে এসে অন্য কোন উপায়ে খুঁজতে থাকে। সে করবী গাছের বীজ তুলে সেগুলো পিষে মিশ্রণ তৈরি করতে শুরু করে।
ভাগ্যক্রমে, তার বোন যে তার বাড়ির কাছে থাকতো সে গিয়ে তাকে সেই বিষাক্ত মিশ্রণ খেতে বাঁধা দেয়।
প্রেমা বলে যে, তার স্বামীর ধার করা অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার চাপ তাকে দুর্বল করে তুলেছে।
ভারী কাজ
স্বামীর মৃত্যুর পর প্রেমাই তার পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারী। সে তার স্বামীর মতোই ইট তৈরির কাজ করে- এটি একটি কায়িক পরিশ্রম ভিত্তিক কাজ, তবে এতে কৃষিকাজের শ্রমিকের তুলনায় বেশি মজুরী মেলে।
“কাজে গেলে আমি দিন প্রতি ২০০ রুপি করে পাই যা আমার পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট,” প্রেমা বলে।
সে সাধারণত তার ছোট দুই ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যায় কারণ স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি তাদের।
কিন্তু চুল বিক্রির আগে তিন মাস ধরে সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তো, তার মানে হচ্ছে সে এত বেশি অর্থ আয় করতে পারতো না।
“আমি অনেক ইট একসাথে বহন করতে পারতাম না। জ্বরের কারণে বেশিরভাগ সময় আমি বাড়িতেই থাকতাম।”
পাহার সমান ঋণ
প্রেমা ধারের অর্থ শোধ দিতে পারতো না। যখন তার ঋণদাতারা অর্থের জন্য চাপ দিতো, তার হতাশা আরো বেড়ে যেতো।
সে পড়াশুনা জানতো না এবং সরকারের স্কিম যা তার মতো মানুষদের সহায়তায় দেয়া হতো সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না।
ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থা জটিল সব নিয়ম সম্বলিত হওয়ার কারণে তা থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কঠিন ছিল।
প্রেমা এবং তার স্বামী স্থানীয় ঋণদাতা এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল।
এসব ঋণ ছিল অনিরাপদ এবং তা শোধ করার প্রক্রিয়া ছিল খুবই ব্যয়বহুল।
প্রেমা যেহেতু বারবার অসুস্থ হয়ে যেতো তাই তার আয় দিন দিন কমতে থাকলো। যা তাকে গভীর হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।
এটা ছিল সেই সময় যখন সে তার চুলি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে সাহায্য
প্রেমা যখন তার স্বার্থের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছায় তখন একজন ভাল দানশীল ব্যক্তি তার সাহায্যে এগিয়ে আসে- যার কারণে তার ভাগ্য ফেরে।
“আমি প্রেমা সম্পর্কে আমার বন্ধু প্রভুর কাছ থেকে জানতে পারি যে একটি ইটের ভাঁটার মালিক,” বলেন বালা মুরুগান।
প্রেমার সংগ্রাম তাকে তার পরিবারের কালো সময়গুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বালা জানে যে কিভাবে দারিদ্র্য মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়।
“আমার বয়স যখন ১০, তখন আমার পরিবারে খাবারের সংকট ছিল। আমার মা আদের পুরনো বই আর খবরের কাগজ কেজি দরে বিক্রি করে দিয়ে সেই অর্থ দিয়ে চাল কেনে।”
এমন মরিয়া অবস্থায় তার মা নিজে আত্মহত্যা করতে এবং তার পরিবারকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, কিভাবে তার মা সন্তানদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়েছিল। “আমার মা প্রথমে কয়েকটি ওষুধ খায় এবং পরে যখন আমার বোন ওষুধ খেতে যায় তখন মা তাকে থামিয়ে দেয়।”
শেষ মুহূর্তে গিয়ে সে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
পরিবারের সদস্যরা তার মাসে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় এবং সে(চিকিৎসক) তার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।
এ ঘটনার পর, বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় বালা দারিদ্র্যকে জয় করতে সক্ষম হয় এবং এখন তার একটি কম্পিউটার গ্রাফিক্স সেন্টার রয়েছে।
আন্তরিকপরামর্শ
বালা প্রেমাকে তার নিজের জীবনের ঘটনা বলে এবং তাকে আশান্বিত হওয়ার কথা বলে।
তার বন্ধু প্রভুর সাথে মিলে সে তাকে খাবার কেনার জন্য কিছু অর্থ দেয়। এর পর পুরো ঘটনাটি বালা ফেসবুকে লেখে।
“একদিনের মধ্যে আমি এক লাখ ২০ হাজার রুপি জোড়ার করি। যখন আমি প্রেমাকে জানাই সে খুবই খুশি হয় এবং বলে যে এতে তার বেশিরভাগ ঋণ শোধ হয়ে যাবে।”
কিন্তু প্রেমার অনুরোধে তহবিল সংগ্রহ বন্ধ করা হয়।
“সে বলে যে সে কাজ করে বাকি ঋণ শোধ করবে,” বলেন বালা।
এখন তাকে প্রতিমাসে বিভিন্ন ঋণদাতাকে ৭০০ রুপি করে যা প্রায় ১০ ডলারের সমান ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
জেলা কর্তৃপক্ষও তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে যে, তাকে দুধ বিক্রির ডিলারশীপ দেয়া হবে।
দুঃখজনক ভাবে, প্রেমার গল্পটিই একমাত্র ঘটনা নয়। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খায়।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, নাইজেরিয়ার পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চরম দারিদ্র্য আক্রান্ত মানুষদের (যাদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারে কম) বাস ভারতে।
প্রেমাকে চারজনের খাবার যোগাড় করতে হয় এবং যেদিন সে আয় করে সেদিনও তার পারিশ্রমিক জনপ্রতি ৭২ সেন্টেরও কম হয়। সে দরিদ্রদের মধ্যেও দরিদ্র।
নতুন জীবন
বালা মুরুগান প্রেমাকে তার সাহায্য দেয়া অব্যাহত রেখেছে।
“এখন আমি বুঝি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমি বাকি ঋণ শোধ দেয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।”
প্রেমা বলে যে সে অচেনা মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে অত্যন্ত খুশি এবং সে এটাকে স্বাগত জানিয়েছে। এটা তাকে তার শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে
সুত্র- বিবিসি